মোঃ সাইফুল ইসলাম মজুমদার: দু’পাশে শুভ্র সাদা মেঘ সবুজের বুকে ছুটে চলা আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু পথ যেন অন্তহীন। হাত বাড়ালেই যেন ছুঁয়ে দেয়া যায় মেঘেদেরকে। মাঝে মধ্য উকি দেয়া সুর্যের আলোয় উঁচু উঁচু পাহাড় গুলোর সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহুগুণে। প্রকৃতির এত কাছাকাছি আসার, বুক ভরে নির্মল বাতাস নেয়ার, আর স্বর্গীয় দৃশ্য দেখে চোখ জুড়ানোর মতন জায়গাই হল বান্দরবান। নীলগিরির মায়াবী হাতছানি অনেকদিন থেকেই আমার প্রকৃতি-পাগল মন প্রবল বেগে আকর্ষণ করছিল। তাই কর্মব্যস্ত জীবনের শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও প্রিয় সহকর্মী সাহেদ ভাইয়ের আমন্ত্রন কাজে লাগাতে ভুল করিনি। প্রকৃতির কারুকাজ হৃদয় ভরে উপভোগ করার আনন্দই আলাদা। এ আনন্দ মনটাকে এনে দেয় চির-সবুজতা। বন-পাহাড়-সাগরের বিশাল বিস্তৃতরূপ মানব মনকে করে তুলে উদার, মহান। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ এবং আল্লাহর প্রেমিক দরবেশগণ দীর্ঘসময় ধরে পাহাড়-পর্বতে, বনে-জঙ্গলে ধ্যানমগ্ন থেকেছেন, মহান প্রভুর সান্নিধ্যে আসার জন্য। একান্তে নিজেকে সঁপে দিয়ে আবেদন-নিবেদন করেছেন চোখের জলে। ফলশ্রুতিতে নিজেকে চিনেছেন। চিনেছেন বিশ্ব স্রষ্টাকে। আল্লাহপাক যেন নিজ হাতে অত্যন্ত দরদভরে অপরূপ মোহিনীরূপে সাজিয়ে তুলেছেন এই প্রকৃতিকে। আকাশের সাথে পাহাড়ের যে কত গভীর-নিবিড় সম্পর্ক তা উপভোগ করার স্থান এই নীলগিরি।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নীলগিরি বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বান্দরবান থানছি সড়ক পথে অবস্থিত। এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন, মনোমুগ্ধকর একটি পর্যটনকেন্দ্র। যেখানে রোদ-বৃষ্টির হাসি-কান্না, বর্ষায় কোমল মেঘের স্পর্শ। রংধনুর বিচিত্র রং-এর খেলা হৃদয় মনে এনে দেয় ছন্দ হিল্লোল। বান্দরবান জেলার বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে মোটরসাইকেল যোগে রাঙামাটি হয়ে রওনা হলাম আমরা দুইজন।
ফুলগাজী থেকে সকাল ৮টায় বান্দরবানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলো আমাদের মোটরসাইকেল। ফেনীর ছাগলনাইয়া, করের হাট দিয়ে রাঙামাটির আঁকাবাকা পাহাড় বেয়ে নয়টিলা, বালুটিলার সৌন্দর্য অবলোকন করে খাগড়াছড়ির দাঁতমারা রাবার বাগানের বুক ছিড়ে যাওয়া সেলফি রোড বেদ করে ঘাগড়া, রানীর হাট, গাবতলী, কাপ্তাই, ভুজপুরি ও লেচুবাগান নামক স্থান দিয়ে ফেরী পার হয়ে বান্দরবান শহরে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল ৪টা হয়ে গেল।
শাহেদ ভাইয়ের বড় ভাই শাহিন ভাইয়ের বাসা জেলা সদরের বনরুপা পাড়ায় দুপুরের খাবার খেয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসার জন্য। বাসায় বসে গুগুল ম্যাপে জানতে পারলাম মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান শহরের বালাঘাটা
এলাকায় অবস্থিত স্বর্ণ মন্দির রয়েছে। ধাতু বলতে কোন পবিত্র ব্যক্তির ব্যবহৃত বস্তুকে বোঝায়। এই বৌদ্ধ মন্দিরে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তি রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা বড় হীনযান বৌদ্ধ মন্দির। ২০০০ সালে দক্ষিণ পূর্ব এশীয় ধাঁচে বার্মার স্থাপত্যবিদের তত্ত্বাবধানে মন্দিরটি নির্মিত হয়। এই পাহাড়ে একটি পুকুর আছে, নাম দেবতা পুকুর। দেবতা পুকুরটি সাড়ে ৩শত ফুট উচুতে হলেও সব মৌসুমেই পানি থাকে। বৌদ্ধ ভানে-দের মতে, এটা দেবতার পুকুর তাই এখানে সব সময় পানি থাকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি বান্দরবানের পর্যটন কেন্দ্র গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হল বুদ্ধ ধাতু জাদি ক্যাং। এই জাদিটি এখন বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের তীর্থ স্থানই নয় দেশী বিদেশী পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষনীয় স্পটে পরিণত হয়েছে। এটি স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত পেলেও এটি স্বর্ণ নির্মিত নয়। মূলত সোনালী রঙের জন্যেই এটির নাম হয়েছে স্বর্ণমন্দির।
বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনার মডেল এখানে রয়েছে। রাতের খাবার খেয়ে শাহিন ভাই ও তার স্ত্রী’র অতিথি পরায়নতা দেখে রীতিমতো আমি মুগ্ধ হলাম। অসম্ভব ভালো মানুষদের মধ্যে তারা দুইজন। ঘুমানোর আগে পরিকল্পনা করে নিলাম পরদিন নীলগিরি যাওয়ার।
সকালে হালকা নাস্তা সেরে মোটরসাইকেল যোগে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ দেখতে গেলাম। লাল রং এর সুন্দর তোরণ পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর নির্মিত জেলা পরিষদের সুবিশাল এলাকা। এখানে রয়েছে জেলা পরিষদ ভবন, একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যত্নে গড়া সুন্দর ফুলের বাগান, বিভিন্ন ফলের গাছ এবং একটি লেক। লেকের পাশে রয়েছে সারি সারি নারিকেলের গাছ ও বিভিন্ন রকমের কাঠের গাছ।
এখানকার পরিবেশ বেশ উপভোগ্য, ঘুরে দেখার মত সুন্দর একটি জায়গা। বান্দরবান সদর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নীলগিরি পাহাড়। ২৯ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়। সেখান থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশে নীলগিরি অবস্থিত। নীলগিরিতে যাওয়ার এই রাস্তাটি সরু, খাড়া এবং পথে রয়েছে অনেক সার্প টার্নিং। মাঝে মাঝে রাস্তাটি বেশ খারাপ, রয়েছে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক, বন্যহাতী চলাচলের রাস্তা, বিপদজনক পাহাড় ধসের সম্ভাবনা, এক পাহাড় অতিক্রম করে অন্য পাহাড় বেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সুরু সেতুসহ অসংখ্য ভয়ংকর পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের নিরন্তর ছুটে চলা। কখনও কখনও রাস্তা এত খাড়া যে নিচে তাকালে পিলে চমকে যায়। এখানে বাতাস খুব নির্মল। ‘‘এখানে একবার দম নিলে একবছর আয়ু বেড়ে যায় এবং একবার দম ছাড়লে একশটি বেমারি বেরিয়ে যায় ‘‘নীলগিরির এ প্রকৃতি যেন আমাদের সকল বেমারি দূর করে নিরোগ করে তুলছে। আমাদের সুদক্ষ ড্রাইভিং এ আল্লাহর মেহেরবানীতে দুপুর ১১টায় আমরা পৌঁছে যাই নীলগিরি রিসোর্টে।
নীলগিরির নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে আমরা অভিভূত হয়ে গেলাম। মায়ায় জড়ানো। স্বপ্নমাখা এ প্রকৃতি। এখানে আকাশের রং এতটাই সুন্দর নীল যে, দু’চোখ ভরে গেল স্বপ্নীল স্নিগ্ধপ্রলেপে। নীল আকাশ সত্যিই অপূর্ব নীল। তাই এই ভরদুপুরে গাঢ় নীলের ওপর সাদা চাঁদ যেন আদুরে মিষ্টিহাসি হাসছিল। আকাশ এত পরিষ্কার স্বচ্ছ হওয়ার কারণ হলো এখানে নেই ধূলিকনা বা কুয়াশা, সবকিছুই অনেক নিচে। বর্ষায় এখানে নরম তুলার মত মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। তাই আকাশ এখানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। দায়িত্বরত সেনা সদস্যদের কাছে নীলগিরির উচ্চতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বললেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নীলগিরির উচ্চতা ৩৬০০ ফিট। আল্লাহু আকবার। কত উচ্চতায় আমরা উঠেছি। নিচের দিকে তাকালে মেঘের চাদরে ঢাকা পাহাড় ও গাছপালাগুলো মনে হচ্ছিল সাগরের গভীর পানির নিচে। উচ্চতা বেশি হওয়ার কারণে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে চলা সাঙ্গুনদীর দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। দৃষ্টি আর একটু প্রসারিত করলে দূরে বঙ্গোপসাগরে জাহাজ চলার দৃশ্যও দেখা যায়।
নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রে রয়েছে পাঁচটি উন্নতমানের কটেজ। একটি সুন্দর ক্যান্টিন, বাচ্চাদের জন্য খেলার ছোটখাটো একটি পার্ক, সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ক্যাম্প, ছোট ছোট আরও কয়েকটি কটেজ এবং একটি হেলিপ্যাড। পুরো পর্যটন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করছেন সেনাসদস্যরা কারণ প্রথমে ম্রো অধিবাসীদের এই কাপ্রুপাড়া এলাকায় সেনাবাহিনীর একটি নিরাপত্তা চৌকি নির্মিত হয়। পরে পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন করে এটিকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপ দান করেন সেনাসদস্যরাই। এখানে কটেজ বুকিং ও খাবারের বুকিং দিতে পূর্বেই যোগাযোগ করতে হয়।
নীলগিরি থেকে ফেরার পথে চিম্বুক সূর্যোদয় নামক স্থানে ক্যাফে সেভেন-এ দুপুরের খাবার সেরে চিম্বুক পাহাড়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মনকে আরো প্রফুল্ল ও সজীব করে তোলে। পাহাড়ের পাদদেশে পাহাড়িদের চাষ করা বিভিন্ন ফল-ফলাদির দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। আমরা সবচেয়ে দামী ফল ড্রাগন ফলের বাগান, আনারস, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফল দেখতে পেলাম এবং সাধ্যমত কিছু ফল নিলাম। পাহাড়ি নারীদের ব্লাউজ এবং নিম্নাংশের পোশাক ‘পিনন’ অনেকটা লুঙ্গির মতো। এতে কোন সেলাই থাকে না।
আমাদের মোটরসাইকেল ননস্টপ চলিতেছে। বিকেল ৪টায় এসে আমরা বান্দরবান জেলা সদরে এসে পৌছেছি। বাসায় গিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে পূনরায় রওয়ানা দিলাম নীলাচল দেখতে।নীলাচল বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এখানে নীলাচল পর্যটন কমপ্লেক্স বান্দরবান জেলা প্রশাসনের তত্তাবধানে বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ার পাহাড়চূড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় এই পর্যটন কেন্দ্র।
নীলাচলকে বাংলার দার্জিলিং বললে বোঝা যায় এর সৌন্দর্য। ২০০৬ সালের পহেলা জানুয়ারি এই প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। এ প্রকল্পে রয়েছে শুভ্রনীলা,‘ঝুলন্ত নীলা’, ‘নীহারিকা’ এবং ‘ভ্যালেন্টাইন পয়েন্ট’ নামে পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় বিশ্রামাগার। কমপ্লেক্সের মাঝে বাচ্চাদের খেলাধুলার ব্যবস্থা এবং বসার ব্যবস্থা রয়েছে। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সাজানো হয়েছে এ জায়গাগুলো। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সামনের পাহাড়ের দৃশ্যও ভিন্ন ভিন্ন রকম। একটি থেকে আরেকটি একেবারেই আলাদা, স্বতন্ত্র। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬শ’ ফুট উঁচু এই জায়গায় বর্ষা, শরৎ কি হেমন্ত— তিন ঋতুতে ছোঁয়া যায় মেঘ। নীলাচল দেখার মধ্য দিয়ে আমরা শেষ করি বান্দরবান ভ্রমনের অপরুপ সৌন্দর্য। ফিরে আসি আপনালয়।