বরগুনায় প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে নয়ন ও রিফাত ফরাজীর নামে কিছু সন্ত্রাসী। নববধূ ও এক যুবক বাধা দিয়েও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি রিফাত কে।
গত বুধবার বরগুনা সরকারী কলেজের সামনে সকাল সাড়ে দশটার দিকে সে বর্বর এ হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য বাংলাদেশ দেখেছে!!
এরকম অসংখ্য সন্ত্রাসী আমরা জীবনভর দেখে এসেছি। এরা প্রায় সবাই নিষ্পাপ হয়েই জম্ম নেয়। অতঃপর একটা অর্থকেন্দ্রিক, আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর ও অস্থিতিশীল সমাজ ব্যবস্থায় এরা বড় হয়। এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়েও অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, অনেকে ব্যবসায় সফল হয়, অনেকেই ভাগ্যের জোরে প্রবাসী হয় অথবা কিছু একটা হয়। আবার অনেকেই নয়ন ও রিফাত ফরাজীর মত খুনী হয়। অনেকেই বলবেন- নয়ন ও রিফাত ফরাজীর খুনী হওয়াটা তাদের চয়েস। আসলেও কি তাই? নয়ন ও রিফাত ফরাজীর খুনী হওয়ার পিছনে কি অন্য কিছুর দায় থাকতে পারে? যেমন সমাজ ব্যবস্থা, রাজনীতি, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায় বিচার- এগুলোর দায় কি থাকতে পারে?
ছেলেটার ফেইসবুক স্ট্যাটাস চেক করে ছেলেটাকে একটা আধা রাজনীতিক-আধা পাড়ার মাস্তান বলে মনে হলো। এ ধরণের ছেলেরা সাধারণত মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকে। এরা এলাকার অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবকদের নিয়ে একটা গ্যাং এর মতন গঠণ করে এবং একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ত্রাসের মত সৃষ্টি করে। এই গ্যাং সদস্যরা বিশ্বাস করে তাদের গ্যাংস্টার ভাই অনেক ক্ষমতাবান এবং ভাইয়ের প্রতি তারা এক ধরণের আনুগত্য প্রদর্শন করে৷ এসব পাতি/বড় মফস্বল /শহুরে গ্যাংস্টারদের ক্ষমতার উৎস মূলত তিনটি-
১. ভায়োলেন্স বা ত্রাস সৃষ্টির ক্ষমতা
২. মাদক, অস্ত্র ও চাঁদাবাজি থেকে আসা অর্থনৈতিক ক্ষমতা,
৩. রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যোগাযোগগত ক্ষমতা যেটি অন্য সকল ক্ষমতার মূল ভিত্তি। ক্ষমতা ১ ও ২ পুরোপুরি নির্ভর করে মূলত ক্ষমতা ৩ এর উপর।
প্রশ্ন হলো? এসব ক্ষমতা নয়ন ও রিফাতের মত মফস্বল তরুণরা কিভাবে অর্জন করে?
আমাদের সমাজে রাজনীতির যে ধারণা ও চর্চা তাতে অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে কোন নেতার যদি ভায়োলেন্স সৃষ্টির বা ত্রাস সৃষ্টির ক্ষমতা না থাকে তাহলে সে নেতার বাজার মূল্য খুব একটা নেই। ত্রাস সৃষ্টি শুধু যে ঐ নেতার প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তোলে তা না, এটি তাকে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে সুরক্ষা দেয়। ফলে রাজনীতির মাঠে ত্রাস সৃষ্টির ক্ষমতা অনেক সময় একটা সারভাইভাল স্কিল।
এসব রাজনীতিবিদের রাজনীতিতে নয়ন, রিফাত ফরাজীরা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, নয়ন, রিফাত ফরাজীদের গ্রুপ ত্রাস সৃষ্টি করতে পারে। দেশী বিদেশী অস্ত্র মিছিলে বা অন্য কোন রাজনৈতিক উপলক্ষ্যে প্রদর্শন করে, কোন রাজনৈতিক কার্যক্রমে অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবকদের নিয়ে হাজির হয়ে কোন মারামারিতে অংশ নিয়ে এরা এদের প্রয়োজনীয়তা রাজনীতিবিদদের কাছে প্রকাশ করে। বিনিময়ে আইন ও বিচারের ফাঁক-ফোকর ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে কিছু রাজনীতিবিদ এদের অস্ত্র, ত্রাস সৃষ্টির সব অপকর্মকে জায়েজ করে দেয়। এটি একটি অনন্য সিমবায়োসিস, যেখানে একজনের ক্ষমতা অপরজনের উপর নির্ভরশীল।
এসব জায়েজকরণের ফলে, গ্যাং এর সদস্যদের ধারণা হয়- তাদের যেকোন কাজ- ইভ টিজিং, মাদক, ত্রাস সৃষ্টি, চাঁদাবাজি বা অন্য যেকোন অপকর্মের কোন বিচার নেই। তাদের কেউ ধরার সাহস করবে না, তাদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগের সাহস করবে না কারণ এসব অভিযোগের প্রতিকার আগেও হয়নি। বিচার থাকলেও বিচারক তাদের গ্যাংস্টার ভাই অথবা তার উপরের রাজনৈতিক নেতা। এদের মামলায় জামিন করানো, অর্থ দিয়ে গ্রেপ্তার-বিচার প্রভাবিত করা, প্রজাতন্ত্রের অসৎ কর্মচারিদের সাথে নিয়ে অপরাধের বিরাট নেটওয়ার্ক গঠণ ইত্যাদি সকল কিছুই নেতা-গ্যাংস্টার-কর্মীর সমষ্টিগত প্রচেষ্টা। ধীরে ধীরে এমন অনেক সন্ত্রাসী অর্থ আর লোকবল ব্যবহার করে নেতাও বনে যান।
এরকম এক সমাজ ব্যবস্থায় নয়ন, রিফাত ফরাজীরা ধরেই নেয়- প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কাউকে কোপালেও তাদের ধরার বা বলার কেউ নাই। ধরলেও বা বললেও আইনের ফাঁক-ফোকর ব্যবহার করে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের প্রভাবিত করার মত রাজনৈতিক গডফাদার তাদের আছে। আর আছে বলেই, ফরাজীরা ধরেই নেয় তাদের এই কাজ দিনে দুপুরে করলেও সেটিকে কেউ বাধা দিবে না। কারণ, নয়ন, ফরাজীরা এই বাধাদানের প্রতিশোধ নিতে জানে। এবং সেই প্রতিশোধের সময় যারা বাধা দিয়েছিল তাদেরকে নয়ন, ফরাজীদের হাত থেকে বাঁচাতে কেউ এগিয়েও আসবে না।
নয়ন, ফরাজীরা কিভাবে এত্তসব জানে জানেন? কারণ, এর আগেও ওরা ত্রাস সৃষ্টি করেছে, করতে দেখেছে এবং সেগুলোর বিচার দেখেনি। কারণ নয়ন, ফরাজীদের সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে তেমন কোন ভালো ধারণা নেই। ওরা একটি দুর্নীতিগ্রস্ত, বিচারহীন, ভায়োলেন্ট সমাজকেই চিনে। যে সমাজে অনেক কিছু করেই পার পাওয়া যায়। মানুষ শিক্ষা অথবা শাস্তির ভয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করে। ওদের মাঝে এ দুটোর কোনটাই নেই। ওর গ্যাং এর সদস্যরাও এমন করেই ভাবে।
তাহলে, নয়ন ও রিফাত ফরাজীদের মত সাধারণ তরুণদের ভয়ংকর নয়ন, রিফাত ফরাজীতে পরিণত হওয়ার পিছনে দায় কি শুধুই রিফাতের? সম্ভবত না!
– হুসাইন আল আজাদ