প্রকৌশলী মোঃসাইফুল ইসলামঃ সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষন ও ধর্ষনের পরে হত্যা এবং অপমান সইতে না পেরে আত্নহত্যা বেড়েই চলছে।যতই দিন যাচ্ছে ততই ভয়াবহ আকার ধারন করছে।মরনব্যাধি ক্যান্সারের চেয়েও ভয়াবহ আকারে বেড়ে চলছে এই ধরনের ঘটনা।
অনেক ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনাও আছে যা মানুষ হয়তো জানেও না। কেবল সংবাদপত্রে শিরোনাম হওয়া গত পাঁচ বছরের শিশু নির্যাতনের চিত্রই খুব ভয়াবহ। শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, আর ধর্ষণের পর অপমানে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে অনেক। এমনকি ধর্ষণের হাত থেকে প্রতিবন্ধী শিশুরাও রেহাই পায়নি।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ২৩২২ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে আরও ৬৩৯ জন শিশু।
অন্যদিকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত চার বছরে সারা দেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩১ জন শিশুকে। এ ছাড়া ধর্ষণের পর অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ১৯ জন শিশু।
আর ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত তিন বছরে সারা দেশে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩১ শিশু। একই সাথে এই তিন বছরে সারা দেশে ১১২ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
বিএসএএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৯৯ শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ২১ শিশু। কিন্ত পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে এসে শিশু নির্যাতনের সংখ্যা আরও বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫২১ শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৪৩ শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ৩০ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে চার শিশু।
ওই সংস্থার ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ওই বছরে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪৬ জন শিশু। আর ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৩৪ জন শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২১ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে দুই শিশু।
২০১৬ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৮ শিশু ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এ ছাড়া সে বছর ৪২ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়।
বিএসএএফের ২০১৭ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয় ৫৯৩ জন শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৬২ জন শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২২ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে সাত শিশু।
২০১৭ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭০ জন শিশু ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর ২০১৭ সালে সারা দেশে ৪৪ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
এ ছাড়া সংস্থাটির সর্বশেষ পরিসখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫৬৩ জন শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয় ১৭৯ শিশু। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫৮ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে ছয় শিশু। এই ১১ মাসে ৯৩ জন শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। এ ছাড়া এই সময়ের মধ্যে ২৬ জন প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়।
সমাজে এমন অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একটি ঘটনা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলে ঘটেছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত লালসা, আচরণগত ও নানা কারণে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের দেশে শিশু ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে, তারা (শিশুরা) ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচার মতো সক্ষমতা রাখে না। খুব সহজেই তাদের ওপর জোর-জবরদস্তি করা যায়। বয়সের কারণে তারা বড়দের মতো প্রতিবাদ করতে পারে না ও আত্মরক্ষাও করতে পারে না। ফলে যে সব মানুষের মধ্যে ধর্ষণ প্রবণতা আছে। তারা এই সুযোগকে কাজে লাগায়। তারা শিশু এবং বিকলাঙ্গ নারীদের টার্গেট করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়াটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ভয়ানক চিত্র ও সতর্কবাণী। ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সব ধর্ষণের ঘটনার পেছনে দায়ী মূলত কয়েকটি বিষয়। প্রথমত হলো- প্রযুক্তির অপব্যবহার। কারণ ইন্টারনেটে অতি সহজে যৌন ছবি, উত্তেজক ভিডিও পাওয়া যায়। ফলে ধর্ষণের নৈরাজ্য বেড়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে- পুঁজিবাদের ফলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে দূরত্ব, পারস্পারিক সম্মানবোধ, সহনশীল আচরণ অনেকটাই কমে গেছে। আর একইসঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। আর তৃতীয়টি হলো- ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের ক্ষেত্রে এক প্রকার শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। এটা থেকে বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়। যখন কোনো ধর্ষণের দ্রুত বিচার না হয়, তখন এটি আরও একটি ধর্ষণের ঘটনার জন্য দায়ী। এই সব বিষয়গুলো যদি সরকার বা রাষ্ট্র মাথায় রেখে কাজ করে, তবে ধর্ষণের ঘটনা অনেকাংশে কমে যেতে পারে।’
আর পুলিশ বলছে বিকৃত মানসিকতা ও মাদকাসক্তির কারণে সমাজের এমন অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে পুলিশ সব সময় এসব ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিদের গ্রেফতারে তৎপর থাকে এবং তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে বদ্ধ পরিকর।
এই ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘শিশুদের ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন ঘটনা বিকৃত মানসিকতা থেকে হয়। মাদকাসক্তিও এর একটি বড় কারণ। এসব আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে।’