সাংবাদিকতায় কি পেয়েছি আর কি হারিয়েছি সেসব বলে লাভ নেই। কিছুই পাইনি বললেও ভুল হবে। অকৃতজ্ঞের সামিল হবে। পেয়েছি অনেক কিছু। সাধারণ মানুষের ভালবাসা আর সম্মান। ব্যর্থ হয়েছি পুলিশ ও প্রশাসন-প্রেমিক সাংবাদিক হতে, তাদের পদলেহন করতে। আল্লাহর অমূল্য দান-দুই চোখে যা দেখেছি, যা সত্য তা লিখে চলেছি। পাছে লোকের কথা আমার মাথায় থাকে না।
আমার মতো এ প্রজন্মের তরুণেরা লেখাপড়া শিখে অনেকেই সাংবাদিকতার মহান পেশায় এসেছে।অনেক সাংবাদিক আজও সৎ, সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সুসাংবাদিকতা করছেন। তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উপজেলার গণ্ডি থেকে সাংবাদিকতার বৃহৎ ক্ষেত্র। আরেকটি বর্ণিল জগৎ।
যারা বাড়ি, গাড়ি আর দালানের মালিক হয়েছেন, তাদের সারাদিন-সারা বছর দেখেছি, পুলিশ আর প্রশাসনের তোয়াজগিরি করতে। জনগণের বিপদাপদ ও মামলা-মোকদ্দমায় পক্ষপাতিত্ব বা পুলিশের সাথে খাতিরের সুযোগে দু’এক পয়সা হাতিয়ে নিতে। সরকারি টিআর-কাবিকা, কাবিটার প্রকল্প নিয়ে উদরপূর্তি করতে। সংবাদের নামে অর্থ হাতিয়ে নিতে। জনগুরুত্ব ও নির্যাতিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের সংবাদ অর্থের বিনিময়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে। অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, দখলদারিত্ব আর টেন্ডারবাজির সংবাদ না করার বিনিময়ে পারিতোষিক নিতে। তারা পুলিশ আর প্রশাসনের সংবাদ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ব্যস্ত থাকেন প্রেসরিলিজ নিয়ে। ঘুর ঘুর করেন নেতা, পাতি নেতাদের পেছন পেছন।
দেশের সবকটি উপজেলা-থানায় একাধিক প্রেসক্লাব দেখা যায়। জানি না, বুঝি না কেনো এমন!। কারণ কখনো প্রেসক্লাবের দায়িত্বে আসার সুযোগ হয়নি। তবে একাংশের সাথে রয়েছি। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হয়, সৎ, নিষ্ঠা, সুসাংবাদিকতা ও অপসাংবাদিকতা-এ নিয়ে শুরু মূল দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব থাকা ভালো। প্রতিযোগিতা বাড়ে। কোন সংবাদ কাকে ফেলে কে আগে করবে-তার দৌঁড় থাকবে। নিজেদের হাত পাকা হবে। জনগণ, দেশ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়বে। তা যেন সুদূরপরাহত। উপেক্ষিত হচ্ছে সুসাংবাদিকতা।
মফস্বল শহরে সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকরা অবহেলিত হওয়ার আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে, অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রেসক্লাব সাংবাদিকরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত, বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত। তারা ঐক্যবদ্ধ না থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতারা যারা অবৈধ ক্ষমতা ব্যবহার করে জনগণের উপর বিভিন্ন চাঁদাবাজি দখলদারিত্ব করে আসছে তাদের জন্য সুবিধা হচ্ছে। অন্যদিকে সুবিধা হচ্ছে পুলিশ প্রশাসনের, বিভিন্ন ধরনের মাদক ও অপরাধমূলক আসামিদেরকে ধরে টাকার বিনিময় রাত বিরাতে ছেড়ে দিচ্ছে। সাংবাদিকদের দু-একজন আবার প্রশাসনের সদস্যদের খুব কাছের বন্ধু। সুতরাং তারাও সুযোগ সুবিধা প্রশাসন থেকে পায়, সে কারণে অনেক তথ্যই ধামাচাপা পড়ে যায়। আর যারা সৎ সাংবাদিকতা করে তারা প্রশাসনের কাছে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। প্রশাসনের অসৎ সাংবাদিক বন্ধু থাকার করনে চাপে থাকতে হয় সৎ সাংবাদিকদের।
রাজনীতিতেও সৎ সাংবাদিকদের গুরুত্ব খুবই কম, অসৎ চাঁদাবাজ, দালাল সাংবাদিকদের গুরুত্ব রাজনৈতিক নেতাদের কাছে অনেক বেশি। আর কোনো সাংবাদিককে বিপদে ফেলতে তথ্যপ্রযুক্তি আইন অথবা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ বলে একটা ট্যাগ তো রয়েছে।
বলতে গেলে মফস্বল শহরে এখন সাংবাদিকদের মূল্যায়ন বা গুরুত্ব নাই। গ্রুপিংয়ের কারণে অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে কেউ না কেউ তাদের সংবাদ প্রকাশ করছে। বিনামূল্যে প্রকাশিত হওয়া সকল সংবাদ পেয়ে তারা চিন্তা করছে যেহেতু মূল্যায়ন না করার পরেও তাদের সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তাহলে সাংবাদিকদের মূল্যায়ন করার প্রয়োজনীয়তা নেই। সে কথাগুলো মফস্বলে থাকা সাংবাদিক বন্ধুরা বুঝতে চায় না।
একটা সত্য সংবাদের উদারহণ দিচ্ছি, থানাপুলিশ মাস দেড়েক আগে এক হাজার ৩০০ লিটার মদ উদ্ধার করেছে। আটক আছে এক মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশপ্রেমিক সাংবাদিকদের সে কী ব্যস্ততা। পুলিশ সাংবাদিকদের ডেকে নিয়ে আগ বাড়িয়ে তথ্য দিল, ছবি তুলল। সাংবাদিকেরা নেমে গেল সংবাদ লিখন ও পরিবেশনায়। কিন্তু সন্ধ্যার আঁধারে এক হাজার ৩০০ লিটার মাদক হয়ে গেল মাত্র ৪৫০ লিটার। তাও আবার পরিত্যক্ত। আর ওই মাদক ব্যবসায়ী হয়ে গেল সাধারণ মাদকসেবীতে। তার কাছ থেকে মাত্র ২লিটার মদ উদ্ধার দেখিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ৩ মাসের কারাদণ্ড দিল।
কি কেরামতি পুলিশের-প্রশাসনের!?
সাংবাদিকদের একজন সন্তর্পণে এই তথ্য পান। তা যাচাই-বাছাই করে সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে। তাতে পুলিশ, প্রশাসনের চেয়ে পুলিশপ্রেমিক সাংবাদিকদের যেন গাত্রদাহের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তাদের স্যারেরা যেন গোস্বা হয়ে গেল। তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। এই সংবাদের পর প্রশাসন নানা সভায় সাংবাদিকদের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ লিখার পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। প্রশাসনপ্রেমিক গুণধর সাংবাদিকেরা তা ভালোই হজম করে চলেছে। অবশ্য তারা লিখেছিল, পুলিশের মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান।
আমাদের বিবেক দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। উপরন্তু চলছে ল্যাং মারার অসুস্থ-হীন মানসিক প্রতিযোগিতা। সৎ ও সত্য সংবাদ লিখলে যেন সুবিধাবাদী সাংবাদিকদের আঁতে ঘা লাগে। পুলিশ-প্রশাসন বা অন্যায়, দুর্নীতি, দখলবাজি, অনিয়ম, অসঙ্গতির সংবাদ লিখলে তো কথাই নেই। সত্য লিখলে প্রশাসন প্রেমিক সাংবাদিকদের সম্মানে আঘাত হানে। ইরাজার অর্থ যেন বেহাত হয়ে যাওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকে। সৎ ও সততার সাথে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অসৎ সাংবাদিকদের ল্যাং খাওয়ার ভয়ও তাড়া করে। কারণ সংবাদের চেয়ে অর্থের মোহে নিমজ্জিত থাকেন অসৎ সাংবাদিকরা। তাদের হাতে প্রচুর সময়। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানার মতো কাজকর্ম তাদের।
শুধু কি মফস্বল সাংবাদিকতায় তা দেখা যায়। নগরেও ভুয়া সাংবাদিক ভুড়ি ভুড়ি। ভুয়া হলেও সাংবাদিক গন্ধ আছে, জাতভাই। এদের কি ব্যস্ততা, দম ফেলার ফুসরত নেই। পুলিশ প্রশাসনও তাদের তোয়াজ করে। সাথে নিয়ে চলে ম্যারাথন আড্ডা। চলে নানা পদের নাস্তাসমেত চা-কিফি।
কথায় বলে, কাক কখনো ময়ূর হয় না। যতই লিখি না কেন অভ্যেস বদলানো কঠিন।
–
সম্পাদক ও প্রকাশক : মোঃ জহিরুল ইসলাম (রাজু)